বিশ্ব আইভিএফ দিবস : বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় আলাদা বিভাগ গঠন করা জরুরি

- ডেস্ক রিপোর্ট:
- 25 Jul, 2025
প্রতি বছর ২৫ জুলাই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব আইভিএফ দিবস’। বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসার সর্বজনীন স্বীকৃত একটি পদ্ধতি আইভিএফ। বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্বের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা রয়েছে, যেমন নারীদের ডিম্বাণু বৃদ্ধির জন্য ওষুধ, হরমোন ইনজেকশন। ডিম্বাশয়, এর নালি ও জরায়ুর সমস্যা নির্ণয়ে ল্যাপারোস্কপি বা স্টেম সেল থেরাপি দেয়া হয়। আবার পুরুষের ক্ষেত্রে শুক্রাণু বৃদ্ধির ওষুধ দেয়া হয়। এসব ছাড়াও বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় আরো আধুনিক পদ্ধতির একটি হচ্ছে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন, যাকে সংক্ষেপে বলা হয় আইভিএফ।
ঢাকার মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫-এর জুন ১২ মাসে ইনফার্টিলিটির সমস্যায় আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১১৩ ও নারী ২ হাজার ৫৯৮ জন। চিকিৎসার পর গর্ভধারণে সক্ষম হন ৬৬৪ দম্পতি।
সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতির দেহ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে কৃত্রিম পরিবেশে তা নিষিক্ত করে পুনরায় স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করাই আইভিএফ, যা একসময় টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতি বলে পরিচিত হয়েছিল। বিশ্বে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে চার দশকের বেশি সময় আগে। বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা মূলত বিভাগীয় শহরভিত্তিক। ঢাকায় শুধু বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে। বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ইনফার্টিলিটি বিভাগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল। সরকারি পর্যায়ে এ সুবিধা সহজলভ্য হলে অনেকের ভোগান্তির অবসান হবে। জেলা পর্যায়ে আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় আলাদা বিভাগ গঠন করা জরুরি।
অন্য দেশের তুলনায় কম খরচ এবং দেশে চিকিৎসার সুযোগ সীমিত থাকায় একসময় বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা করাতে অনেক দম্পতি ভারতে যেতেন। তবে গত পাঁচ-ছয় বছরে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে অনেক আইভিএফ সেন্টার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে অনেকের সাফল্যের হার বিদেশের উন্নত মানের সেন্টারগুলোর মতোই। এখন প্রায় সব ধরনের বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা দেশেই সম্ভব হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
এছাড়া বিদেশের চেয়ে খরচও অনেক কম হয়। তারা জানান, আইভিএফ চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। কারণ স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই যেতে হয়। অন্তত সাত-আটবার যেতে হয়। দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করতে হয়। কর্মজীবী দম্পতির ক্ষেত্রে লম্বা সময় বাইরে থাকাও সম্ভব হয় না। দেশে অনেক চিকিৎসক বিদেশ থেকে আইভিএফ ও অন্য চিকিৎসার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রযুক্তিগত দিক থেকেও দেশের আইভিএফ সেন্টারগুলো অগ্রসর হয়েছে। এসব কারণে দম্পতিদের বিদেশ বিশেষত ভারতমুখিতা কমেছে এবং দেশে সেবা নেয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার হুসনা আরা ও আহসানুল হক দম্পতি। দুজনই শিক্ষকতা করেন। দাম্পত্য জীবনের প্রায় ১৫ বছর কেটে গেলেও এখনো সন্তানের মুখ দেখা হয়নি তাদের। সন্তান নিতে অনেক ধরনের চিকিৎসাও নিয়েছেন এ দম্পতি। কিন্তু কাজ হয়নি। শেষমেশ আইভিএফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এ দম্পতি। শুরুতে বিদেশে যাওয়ার চিন্তা করলেও দীর্ঘ সময় অবস্থান ও বড় খরচের তুলনায় দেশে সমমানের সেবা সহজলভ্য হওয়ায় এখন দেশেই আইভিএফ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা।
দেশে আইভিএফের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেসরকারি পর্যায়ে বেশকিছু আইভিএফ সেন্টার গড়ে উঠেছে। তবে আইভিএফ চিকিৎসা সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল হওয়ায় অনেকে ইচ্ছা থাকলেও এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারেন না। অন্যদিকে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর মধ্যে শুধু ঢাকা মেডিকেলে রয়েছে আইভিএফ সেবা। কিন্তু স্বভাবতই এখানে সেবার পরিসর সীমিত হওয়ায় চাহিদা অনুসারে সবাইকে সেবা দেয়া সম্ভব হয় না। তাই সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে এ সেবা চালু করলে আরো বেশি দম্পতি এ সুবিধা পেতে পারেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সন্তান ধারণের চেষ্টা করার পর টানা এক বছর যদি কেউ সফল না হন তাহলে তাকে ইনফার্টাইল বা সন্তান ধারণে অক্ষম হিসেবে গণ্য করা হয়।
দেশে কত শতাংশ দম্পতি বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভুগছেন তা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনে কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্ব শনাক্তকরণ বেড়েছে। দম্পতি চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হচ্ছেন বলেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। ‘ইনভিজিবল ওমেন ইন বাংলাদেশ: স্টেকহোল্ডার’স ভিউজ অন ইনফার্টিলিটি সার্ভিসেস’ শীর্ষক একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে দেশের প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ বন্ধ্যাত্বে ভুগছে। দক্ষিণ এশিয়ায় বন্ধ্যাত্বের সমস্যায় ভোগাদের ৪ শতাংশই বাংলাদেশের।
ঢাকার মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে ২০২৫-এর জুন—১২ মাসে ইনফার্টিলিটির সমস্যায় আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১১৩ ও নারী ২ হাজার ৫৯৮ জন। চিকিৎসার পর গর্ভধারণে সক্ষম হন ৬৬৪ দম্পতি।
সন্তান জন্মদানে অক্ষম দম্পতির দেহ থেকে শুক্রাণু ও ডিম্বাণু সংগ্রহ করে কৃত্রিম পরিবেশে তা নিষিক্ত করে পুনরায় স্ত্রীর জরায়ুতে স্থাপন করাই আইভিএফ, যা একসময় টেস্টটিউব বেবি পদ্ধতি বলে পরিচিত হয়েছিল। বিশ্বে এ পদ্ধতি চালু হয়েছে চার দশকের বেশি সময় আগে।
বাংলাদেশে বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসা মূলত বিভাগীয় শহরভিত্তিক। ঢাকায় শুধু বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসায় বেসরকারি ক্লিনিক রয়েছে। বড় বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ইনফার্টিলিটি বিভাগ রয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসা কিছুটা ব্যয়বহুল। সরকারি পর্যায়ে এ সুবিধা সহজলভ্য হলে অনেকের ভোগান্তির অবসান হবে। জেলা পর্যায়ে আটটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্ধ্যাত্ব চিকিৎসায় আলাদা বিভাগ গঠন করা জরুরি।
দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, তাদের কাছে যেসব দম্পতি আসেন তার মধ্যে সন্তান ধারণে অক্ষমতায় নারী ও পুরুষের সংখ্যায় খুব বেশি তারতম্য নেই। দেখা যায় দম্পতিদের মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে স্ত্রী এবং কিছু ক্ষেত্রে স্বামীর শারীরিক সমস্যা থাকে। বাকি ক্ষেত্রে দুজনেরই সমস্যা থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আজানা সমস্যাও দেখা যায়।
অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও সন্তানহী দম্পতিকে সামাজিক ও মানসিকভাবে বিভিন্ন সংকটে পড়তে হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দম্পতির মধ্যে বিচ্ছেদও ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে যুক্ত হয় দাম্পত্য কলহ।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আসমা আক্তার (ছদ্মনাম)। বিয়ের প্রায় নয় বছর অতিক্রম হলেও এখনো নিঃসন্তান তিনি। আসমা বলেন, ”সন্তান না হওয়ায় আমি মানসিক চাপে থাকি। এখন পারিবারিক কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকি না। আবার সন্তান হয় না বলে বলে অনেক অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকাও হয় না। এসব কারণে নিজেকে সবকিছু থেকে আলাদা করে নিয়েছি।’
মোহাম্মদপুর ফার্টিলিটি সার্ভিসেস অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের ইনফার্টিলিটি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. রহিমা খাতুন বলেন, ‘বিশ্বে প্রতি ছয়টি দম্পতির একটি বন্ধ্যাত্বের শিকার। আগে দেখা যেত নারীদের সমস্যা বেশি হতো। কিন্তু এখন আগের তুলনায় পুরুষের বন্ধ্যাত্ব বেশি ডায়াগনোসিস হচ্ছে। আমাদের এ সেন্টারে আইভিএফ ছাড়া বন্ধ্যাত্বের বাকি সব ধরনের চিকিৎসা দেয়া হয়। আইভিএফ পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল। কিন্তু সরকার থেকে যদি সহযোগিতা করা হয়, তাহলে এর খরচ অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। আবার এক্ষেত্রে খুব দক্ষ জনবলের দরকার হয়। আমাদের দেশে এখন অনেক দক্ষ চিকিৎসক রয়েছেন। সরকার মেডিকেল কলেজগুলোয় আইভিএফ সেবা চালুর উদ্যোগ নিতে পারে।’
Leave a Reply
Your email address will not be published. Required fields are marked *
সর্বাধিক পঠিত সংবাদ
